টেকসই নগরায়ণের চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা

ছবি : সংগৃহীত।

অর্থনীতি ও নগরায়ণের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আবাসন খাত আজ কেবল একটি ব্যবসা নয়, বরং জাতীয় উন্নয়নের কৌশলগত শিল্পে পরিণত হয়েছে। বর্তমানে আবাসন খাতের বাজারমূল্য প্রায় ৩০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা দেশের মোট জিডিপির ৭ থেকে ৮ শতাংশ। প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সিমেন্ট, ইস্পাত, টাইলস, কাচ, বৈদ্যুতিক সামগ্রী, পরিবহন ও আসবাব খাতের তিন শতাধিক শিল্প এই খাতের সঙ্গে জড়িত। 

কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রেও এর ভূমিকা বিশাল; প্রায় ৪০ লাখ মানুষ এই খাতের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করছেন। কিন্তু সম্ভাবনাময় এই খাতের ভেতরেই লুকিয়ে আছে বহুমাত্রিক সংকট। 

বিশ্বের অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ এই মহানগরে প্রতিবছর অন্তত দুই লাখ নতুন ফ্ল্যাটের চাহিদা তৈরি হলেও সরবরাহ হচ্ছে মাত্র ৫০-৬০ হাজার ইউনিট। ফলে প্রতিবছর প্রায় দেড় লাখ ইউনিটের ঘাটতি থেকে যাচ্ছে। এই ঘাটতির সরাসরি অভিঘাত পড়ছে মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত জনগোষ্ঠীর ওপর। তাদের ভাড়া বাড়ছে অস্বাভাবিক হারে এবং সাশ্রয়ী আবাসনের স্বপ্ন থেকে যাচ্ছে অধরা। 

ঢাকার আবাসন সংকট বোঝার জন্য কয়েকটি বাস্তবতা মনে রাখা জরুরি। প্রথমত, বর্তমানে ঢাকায় বাস করছে প্রায় ২ কোটি ৩০ লাখ মানুষ। বার্ষিক জনসংখ্যা প্রবৃদ্ধি ৩-৪ শতাংশ, যা বিশ্বের নগর প্রবৃদ্ধির গড়ের দ্বিগুণ। এই বিপুল জনসংখ্যার অন্তত ৪০ শতাংশ বাস করছে অনানুষ্ঠানিক আবাসনে। অর্থাৎ বস্তিতে। 

দ্বিতীয়ত, ঢাকার আয়তন মাত্র ৩০৬ বর্গকিলোমিটার, যার প্রায় ৭০ শতাংশ জমি ইতোমধ্যে ব্যবহার হয়ে গেছে। নতুন প্রকল্পের জন্য জমি পাওয়া দুষ্কর। ফলে শহর ক্রমেই বহুতল ভবননির্ভর হয়ে উঠছে। আবার বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানি সরবরাহ, ড্রেনেজ ব্যবস্থা ও সড়ক নেটওয়ার্ক যথাযথ উন্নত না হওয়ায় প্রতিটি নতুন আবাসিক এলাকা নতুন সংকট তৈরি করছে।

ঢাকার আবাসন খাতের আরেকটি বড় সমস্যা হলো অর্থায়ন। বাংলাদেশের মর্টগেজ ফাইন্যান্স টু জিডিপি অনুপাত মাত্র ১ দশমিক ৯ শতাংশ, যেখানে ভারতের ১০, মালয়েশিয়ার ৩২, চীনের ২৬ এবং যুক্তরাষ্ট্রের ৬৫ শতাংশ। উন্নত দেশে যেখানে গৃহঋণ ২০ থেকে ৩০ বছরের জন্য পাওয়া যায়, বাংলাদেশে ঋণের মেয়াদ সীমিত ১০ থেকে ১৫ বছরে। তার ওপর সুদহার ১০ থেকে ১২ শতাংশ, যা দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সর্বোচ্চ। ফলে মধ্যবিত্ত শ্রেণি গৃহঋণ নিতে নিরুৎসাহিত হয়, আর ডেভেলপাররাও দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগে ঝুঁকতে চায় না।

একই জমির ওপর একাধিক মালিকানা দাবির ঘটনা অস্বাভাবিক নয়। একটি আবাসন প্রকল্প অনুমোদন পেতে গড়ে দুই-তিন বছর সময় লাগে। যার ফলে ব্যয় বাড়ে এবং শেষ পর্যন্ত ক্রেতার ওপর চাপ পড়ে। অন্যদিকে করনীতিও সাশ্রয়ী আবাসনের পথে বড় বাধা। 

জমি রেজিস্ট্রি ফি, স্ট্যাম্প ডিউটি, ভ্যাট ও ইনকাম ট্যাক্স মিলে একটি ফ্ল্যাটের দামে ১৫ থেকে ২০ শতাংশ অতিরিক্ত ব্যয় যুক্ত হয়, যা মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত ক্রেতার নাগালের বাইরে ঠেলে দেয়।

আশার আলো হতে পারে আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা। সিঙ্গাপুরে হাউজিং ডেভেলপমেন্ট বোর্ড (এইচডিবি) সরকারি জমি ব্যবহার করে প্রায় ৮০ শতাংশ নাগরিককে সাশ্রয়ী দামে ফ্ল্যাট সরবরাহ করেছে। মালয়েশিয়ায় পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ মডেলে সরকার অবকাঠামো দিয়েছে; বেসরকারি খাত নির্মাণ করেছে। 

ভারতে প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনা প্রকল্প কোটি কোটি ফ্ল্যাট নির্মাণের মাধ্যমে নিম্ন ও মধ্যবিত্তের জন্য নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে, যেখানে ভর্তুকি, কর রেয়াত ও ব্যাংক ঋণ সমন্বিতভাবে কাজ করছে।

সবচেয়ে বড় কৌশলগত পদক্ষেপ হবে ঢাকার বাইরে স্যাটেলাইট সিটি গড়ে তোলা। পুবাইল, কেরানীগঞ্জ, সাভার, গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জে আধুনিক স্যাটেলাইট শহর তৈরি করে রাজধানীর ওপর চাপ কমানো সম্ভব। এর সঙ্গে একীভূত পরিবহন নেটওয়ার্ক– মেট্রোরেল, এক্সপ্রেসওয়ে ও নদী পরিবহন নিশ্চিত করতে হবে। একই সঙ্গে বস্তি এলাকাকে শুধু উচ্ছেদ না করে পুনর্বাসন কর্মসূচির আওতায় আনতে হবে, যাতে নিম্ন আয়ের মানুষের আবাসনের অধিকার নিশ্চিত হয়।

ঢাকার মতো অতিরিক্ত চাপের নগরে এখনই পদক্ষেপ না নিলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে একটি অগোছাল ও অমানবিক নগরজীবন উপহার দেওয়া ছাড়া কোনো উপায় থাকবে না। তাই সময় এসেছে সরকার, ব্যাংক ও বেসরকারি উদ্যোক্তাদের মধ্যে সহযোগিতামূলক অংশীদারিত্ব গড়ে তোলার।

কবীর আহমেদ ভূঁইয়া: উন্নয়ন কৌশলবিদ


  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

চলতি বছর ডেঙ্গুতে মৃত্যুর সংখ্যা ২৫০ ছাড়াল

পাবিপ্রবিতে বৃক্ষরোপণ ও ডিজিটাল বুথ উদ্বোধন

শিক্ষকদের উদ্দেশে প্রধান উপদেষ্টার বার্তা

টেকসই নগরায়ণের চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা

বাদ পড়লেন চিত্রনায়ক ফেরদৌস

আন্দোলন প্রত্যাহার করে ক্লাসে ফেরার ঘোষণা শিক্ষকদের

সন্ধ্যায় প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎ করবে বিএনপির প্রতিনিধি দল

সিরিজ জয়ের মিশনে টসে জিতে ব্যাটিংয়ে বাংলাদেশ

ভোলায় ২ হাজার গাছ রোপণ করেছে গ্রামবাসী

শিক্ষকদের বাড়িভাড়া ভাতা আরও বাড়াল সরকার

১০

সিরাজগঞ্জে নবজাতক চুরি মামলায় নারীর কারাদণ্ড

১১

আমরণ অনশনে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন কয়েকজন শিক্ষক

১২