মামুন রেজা মরে গেলেন, কী বলে গেলেন?

ছবি সংগৃহীত ।

শুক্রবার রাত সোয়া দশটার দিকে সাবেক সহকর্মী, বিবিসির সাংবাদিক আহসান হিমেল ফেইসবুক মেসেঞ্জারে লিখলেন: ‘মামুন রেজা ভাই মারা গেছে!’

আমি তখন এক প্রতিবেশীর বাসায় বসে গল্প করছি। হিমেল এটা কী লিখলেন তা বোঝার চেষ্টা করি। মামুন রেজা মানে তো আমাদের মামুন রেজা। চ্যানেল টোয়েন্টিফোরে আমার সাবেক সহকর্মী। খুলনার ব্যুরো প্রধান। মামুন রেজা ভাই মারা গেছে মানে কী? এটা কী ধরনের খবর! হিমেলকে ফোন করলাম। বললেন, ‘ভাই খবর সত্যি। আমার হাত পা কাঁপতেছে।’ টের পেলাম হাত পা আমারও কাঁপছে। কিন্তু বিশ্বাস হচ্ছিল না অথবা বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিল। চট করে মনে পড়ল শাহীন ভাইয়ের কথা। খুলনার সাংবাদিক শামসুজ্জামান শাহীন। মামুন ভাইয়ের ঘনিষ্ঠ। ফোন রিসিভ করার পরে শুধু এটুকু জিজ্ঞেস করলাম: ভাই ঘটনা কী? শাহীন ভাই বললেন, ‘ভাই, মামুন নাই…’। এরপর হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করলেন।

আমার কান থেকে বাক্যটা মস্তিষ্কের প্রতিটি কোষে আঘাত করছিল। মামুন নাই।

মামুন নাই মানে কী! আমার সঙ্গে তো গত মঙ্গলবারও কথা হলো হোয়াটসঅ্যাপে। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুজন শিক্ষকের ফোন নম্বর চেয়েছিলাম। তিনি লিখলেন: ‘ভাইয়া আমি মালয়েশিয়ায় রয়েছি। ২২ তারিখে ফিরব ইনশাআল্লাহ । ফেরার পর পাঠিয়ে দেব।’

অথচ ২০ তারিখ রাতে শুনলাম মামুন নাই। তার মানে তিনি ২২ তারিখের আগেই দেশে ফিরেছেন। শরীর খুব খারাপ করছিল?

শাহীন ভাই জানালেন, কয়েকদিন আগে মামুনের চেহারা বেশ শুকনো দেখে জিজ্ঞেস করেছিলেন, কী সমস্যা মামুন? বলেছিলেন, ‘শরীরটা ভালো না ভাই।’

শরীরটা ভালো না মানে কী? তার যে হৃদযন্ত্র বসে গেছে, চূড়ান্ত হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকিতে আছেন, সেটা টের পাননি নাকি পেয়েছিলেন? হার্ট অ্যাটাকে মামুন রেজা মারা গেলেন ৪৫ বছর বয়সে। ৭২ বছর গড় আয়ুর দেশে ৪৫ বছর নিশ্চয়ই অনেক বয়স নয়।

চ্যানেল টোয়েন্টিফোরের নিউজ এডিটর থাকাকালীন আমাকে দীর্ঘদিন অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে ন্যাশনাল ডেস্ক সামলাতে হয়েছে। সেই সুবাদে ঢাকার বাইরের ব্যুরো প্রধান, রিপোর্টার ও প্রতিনিধিদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রাখতে হয়। সবার সঙ্গে সমান সম্পর্ক গড়ে ওঠে না। কারো কারো সঙ্গে সম্পর্ক হয় অম্লমধুর। কারো সঙ্গে খুবই ঘনিষ্ঠ। মামুন রেজা ছিলেন তাদের একজন। সম্ভবত তার বাড়ি আর আমার বাড়ির মধ্যে দূরত্ব একশো কিলোমিটারেরও কম বলে। হয়তো এটা আঞ্চলিকতার টান। অথবা মামুন রেজা অসম্ভব ভালো মানুষ ছিলেন বলে।

তার সঙ্গে ব্যক্তিগত স্মৃতির সংখ্যা অনেক। তার সরলতার একটা ছোট্ট উদাহরণ দিই। চ্যানেল টোয়েন্টিফোরে আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম যে, ঢাকার বাইরের রিপোর্টে সংশ্লিষ্ট রিপোর্টার বা প্রতিনিধিদেরই ভয়েস যাবে। সুতরাং সবাইকে সময় বেঁধে দেওয়া হলো যে, এই সময়ের মধ্যে সবাই নিজেদের উচ্চারণ ত্রুটি দূর করবেন। প্রয়োজনে কোর্স করবেন। কিন্তু নির্দিষ্ট সময়ের পরেও বারবার মামুন ভাই সময় নিচ্ছিলেন। কারণ তিনি মনে করছিলেন যে, তার ভয়েস ঠিক হচ্ছে না। তাকে নানাভাবে আশ্বস্ত করতাম। সাহস দিতাম। তিনি উজ্জীবিত হতেন। কিন্তু পরের মাসে গিয়ে আবার একই কথা বলতেন যে, ‘ভাই আমাকে দিয়ে এটা হবে না।’ কিন্তু আমরাও হাল ছাড়িনি। শেষ পর্যন্ত রিপোর্টে তার নিজের কণ্ঠই যেত।

মামুন রেজার সঙ্গে সাংবাদিকতা সম্পর্কিত বড় বিষয়ে সবশেষ কথা হয় গত বছরের ৫ অগাস্ট সরকার পতনের মাসখানেক পরে খুলনায় উৎসব মণ্ডল নামে এক তরুণের মৃত্যুর সংবাদ নিয়ে। খবরে বলা হয়েছিল, মহানবী (সা.)-কে নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ‘কটূক্তিমূলক’ পোস্ট করায় উৎসব মণ্ডল (২২) নামে এক তরুণকে পুলিশের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে গণপিটুনি দিয়ে মেরে ফেলা হয়েছে। খবরটি সমকালে মামুন রেজাই প্রথম দিয়েছিলেন। তার ওই খবরের স্ক্রিনশট আমি ফেইসবুকে শেয়ার করার পরে তীব্র প্রতিক্রিয়া শুরু হয়। ততক্ষণে মামুন রেজার ওপরেও নানা দিক থেকে চাপ আসতে থাকে। তিনি আমাকে ফোন করে অনুরোধ করলেন যাতে পোস্টটা আমি এডিট করে দিই। কেননা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তরফে বলা হচ্ছে, ওই তরুণ বেঁচে আছেন। পরে সংবাদটি সংশোধিত আকারে প্রকাশিত হয়। এর কিছুদিন পরে জানা গেলো যে, উৎসব মণ্ডলের পরিবার খুলনার যে বাসায় ছিলে, সেখান থেকে তারা চলে গেছে। কোথায় গেছে কেউ জানে না। উৎসব মণ্ডলকে নিয়ে এরপরে আর কোনো খবরও চোখে পড়েনি। যদ্দুর জানি, ওই সংবাদ নিয়ে মামুন রেজাকে অনেক চাপ সহ্য করতে হয়েছিল।

অদ্ভুত ব্যাপার হলো, গত ২৭ মে ‍খুলনা মেডিকেলের মর্গের সামনে নীল শার্ট গায়ে দাঁড়িয়ে মামুন রেজা একটি ছবি পোস্ট করেন ফেইসবুকে। কিন্তু প্রায় এক মাসেও ওই ছবির নিচে কেউ কোনো কমেন্ট করেননি। মৃত্যুর পরে বায়েজিদ খান নামে একজন ওই ছবির নিচে লিখেছেন: ‘আপনি এই পোস্ট ক্যান করেছিলেন বলতে পারবেন? ক্যান? এক মাসের ব্যবধানে আপনি এখানে ফিরলেন আলাদা পরিচয় নিয়ে। ও বড় ভাই, ও বড় ভাই!’

এই হাহাকার তো আমাদেরও। আমরাও তো জানি না মামুন রেজা কী এক বেদনার ভার বইয়ে চলেছিলেন ভেতরে ভেতরে।

২.

খুলনার সাংবাদিক মামুন রেজার মৃত্যু স্মরণ করিয়ে দেয় বরিশালের সাংবাদিক লিটন বাশারকে। ২০১৭ সালের জুন মাসে তিনিও এরকম হঠাৎ করে মরে যান। একটা জ্বলজ্যান্ত মানুষ। অফুরাণ তার প্রাণশক্তি। বাইরে থেকে দেখলে বোঝার ‍উপায় ছিল না তার শরীরে বড় কোনো অসুখ আছে। লিটন বাশার যখন মারা যান, তখন তার বয়সও ৪৬। তার অবসরপ্রাপ্ত স্কুলশিক্ষক পিতাকে ছেলের লাশ কাঁধে করে কবরস্থানে যেতে হয়েছে।

লিটন বাশার কেন গুরুত্বপূর্ণ? কারণ তিনি বিপদগ্রস্ত সাংবাদিকের পাশে থাকতেন, সাহস জোগাতেন। লিটন বাশার ছিলেন সাহসী। যা সত্য ও সঠিক, সেটিই অকপটে বলতেন কাউকে পরোয়া না করেই। তার এই ঠোঁটকাটা স্বভাবের জন্য তার অনেক শত্রুও ছিল। কিন্তু লিটন বাশার সব সময়ই ছিলেন স্পষ্টভাষী।

প্রশ্ন হলো, বয়স পঞ্চাশ হওয়ার আগেই মামুন রেজা ও লিটন বাশারের মৃত্যু কি বিশেষ কিছুর ইঙ্গিত দেয়? প্রশ্নটা এ কারণে যে, একজন দায়িত্বশীল ও ভালো সাংবাদিকের মৃত্যু শুধু ওই পরিবার বা ম্যাক্রো লেভেলে সংবাদমাধ্যমেরই ক্ষতি নয়; বরং মাইক্রো লেভেলে ওই প্রতিষ্ঠানটিরও বড় ক্ষতি। সুতরাং মাঝবয়সে একজন সাংবাদিকের মৃত্যু কি এটা প্রমাণ করে যে, কর্মক্ষেত্রে মাত্রাতিরিক্ত কাজের চাপের পরও তাদের অনেকেরই পর্যাপ্ত মেডিকেল পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয় না? 

কয়টা গণমাধ্যমপ্রতিষ্ঠান তার কর্মীদের স্বাস্থ্যের খবর রাখে? বরং সময়মতো সংবাদ পাঠাতে না পারলে, অফিসের বস বলার সঙ্গে সঙ্গে লাইভ দেওয়ার জন্য স্পটে যেতে না পারলে, নিউজ দেওয়ার পরেও ডিজিটাল প্লাটফর্মের জন্য কনটেন্ট দিতে না পারলে ভর্ৎসনার শেষ নেই। কিন্তু যে মানুষটা মাসের তিরিশ দিন খাটছেন, তার বিনিময়ে তাকে কয় টাকা বেতন দিচ্ছে এবং ঢাকার সহকর্মীদের তুলনায় তাদের সুযোগ-সুবিধার অবস্থা কেমন; তাদের শরীর স্বাস্থ্যের কী অবস্থা—সেই খবর নেওয়ার প্রয়োজনবোধ করে খুব কম কর্তৃপক্ষই। অথচ গণমাধ্যমের স্বার্থেই এটা জরুরি। কেননা সাংবাদিকরা যে প্রতিষ্ঠানটি গড়ে তুলছেন, যে সাংবাদিকরা প্রতিষ্ঠানকে বাঁচিয়ে রাখছেন, তাদের কাছ থেকে সর্বোচ্চ কাজটা নিতে হলে তাকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। না হলে আখেরে ক্ষতিটা ওই পুঁজিরই। যদিও এখন একজন সিনিয়র চলে গেলে অনেক সময় মালিকপক্ষ খুশি হয় যে, যাক, এবার তার বদলে কম পয়সায় কাউকে পাওয়া যাবে!

৩.

ঘনিষ্ঠ সাংবাদিকদের মধ্যে আরও তিনটি মৃত্যু আমাকে ভীষণভাবে বেদনার্ত করে। দীপু হাসান। সুদীপ দে ও সীমান্ত খোকন। প্রথম আলোর প্রতিনিধি থাকা অবস্থায় ঢাকা অফিসে যাদের সঙ্গে সবচেয়ে বেশি ঘনিষ্ঠতা তৈরি হয়, দীপু হাসান ছিলেন তাদের অন্যতম। প্রথম আলো ছেড়ে পরে তিনি নানা জায়গায় কাজ করেছেন। দীর্ঘদিন কাজ করেছেন একাত্তর টিভিতে। হঠাৎ একদিন শুনলাম দীপু ভাই মারা গেছেন!

মৃত্যুর আগের দিনগুলোয় তিনি বেকার ছিলেন। ফলে তার আর্থিক টানাপোড়েনের বিষয়গুলো জানতাম। নিজেই কিছু একটা করার চেষ্টা করছিলেন। হয়ে ওঠেনি। তার মধ্যে লোন নিয়ে একটা ফ্ল্যাট কিনেছিলেন। ফলে মৃত্যুর পরে ওই লোন শোধ করতে গিয়ে ভাবির ওপর দিয়ে যে কী ঝড় বয়ে গেছে, তা ঘনিষ্ঠজনরা জানেন। সেটা এখনও শোধ হয়নি। দুয়েকজন বড় সাংবাদিককে বলেছিলাম প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে তার পরিবারের জন্য একটা সম্মানজনক আর্থিক সহায়তার ব্যবস্থা যদি করা যায়। কিন্তু সেটা আর হয়নি। অনেক বড় মানুষকে আমরা বাইরে থেকে যেভাবে দেখি বা যেভাবে চিনি, ভেতরে ঢুকলে অন্য চেহারা দেখতে হয়। যাই হোক, ওপরের দিকে থুতু ফেলার ইচ্ছা নেই।

আরটিভির সাংবাদিক সীমান্ত খোকনের মৃত্যুটি আরও করুণ। তিনি বেছে নিয়েছিলেন আত্মহননের পথ। গত বছরের অক্টোবরে। সীমান্ত খোকন নিজেই নিজের সীমান্ত ঠিক করে নিয়েছিলেন। তিনি মারা যান ৫৩ বছর বয়সে।

মামুন রেজা বা লিটন বাশারের মতো আরও অনেক সাংবাদিক তরুণ বয়সে বা জীবনের এমন একটি সময়ে পৃথিবী ছেড়ে চলে যাচ্ছেন, যখন তার ঘরে এক বা একাধিক ছোট সন্তান; স্ত্রী হয়তো কোনো চাকরি করেন না। ফলে তার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে ওই পরিবারটি ভীষণ অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে যায়। এর একটি বড় উদাহরণ আমার আরেক সাবেক সহকর্মী সুদীপ দে—সবশেষ গাজী টেলিভিশনে চাকরি করতো। ২০২২ সালের ২১ অগাস্ট যখন তার মৃত্যু হয়, তখন বয়স ৩৫ বা তার কিছু কম-বেশি। সুদীপ যখন মারা যায় তখন তার স্ত্রী সন্তানসম্ভবা। পরিবারের লোকেরা জানিয়েছেন, পারিপার্শ্বিক নানা চাপ ও অনিশ্চয়তা তাকে মানসিকভাবে দুর্বল করে দিয়েছিল। মৃত্যুর আগে রাজধানীর পান্থপথের একটি হাসপাতালে যখন তার সঙ্গে সবশেষ দেখা হয়, তখন তার এলোমেলো অবস্থা দেখে জিজ্ঞেস করেছিলাম: তোর আসলে কী সমস্যা? উদ্ভ্রান্তের মতো সুদীপ বলছিল: ‘দেখো ভাই ডাক্তার আমার মাথা ঠান্ডা করার ওষুধ দিছে। আমি কি পাগল?’ তার কিছুদিন পরে শুনি সুদীপ মারা গেছে। চিকিৎসকের ভাষায়, মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ। কী এমন চাপ ছিল তার যে মস্তিষ্ক সেই ভার বহন করতে পারল না?

৪.

যুক্তরাষ্ট্রের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন গবেষক তার একটি গবেষণার জন্য কয়েকটি প্রশ্ন পাঠিয়েছিলেন। তার মধ্যে একটি প্রশ্ন এরকম: কোন বিষয়গুলো বাংলাদেশের সাংবাদিকদের মানসিক চাপে রাখে বলে আপনি মনে করেন? আমি এর জবাব দিয়েছিলাম: চাকরির অনিশ্চয়তা ছাড়া আর যে কোনো চাপ মোকাবেলার সক্ষমতা আমাদের আছে। যে কোনো সামাজিক ও রাজনৈতিক চাপ এমনকি আইনি জটিলতা মোকাবেলা করেও সাংবাদিকরা অভ্যস্ত। কিন্তু কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিলে বাংলাদেশের সাংবাদিকদের সারা বছরই কম-বেশি চাকরির অনিশ্চয়তার ভেতরে থাকতে হয়। তাছাড়া সর্বজনগ্রাহ্য কোনো বেতন কাঠামো নেই। হাতেগোণা কিছু প্রতিষ্ঠান ওয়েজ বোর্ড মেনে চলে। কিন্তু ইলেকট্রনিক ও অনলাইন মিডিয়ায় সেটিও অনুপস্থিত। একটানা অনেক বছর কোনো একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করার পরে যেদিন তিনি সেই প্রতিষ্ঠান ছেড়ে দেবেন, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাকে যেতে হয় শূন্য হাতে। বিরাট সংখ্যক প্রতিষ্ঠানে বেতন অনিয়মিত।

প্রশ্ন হলো, পেশাগত অনিশ্চয়তার কারণে বাংলাদেশের কী পরিমাণ সাংবাদিক মানসিক চাপে আছেন এবং তার ফলে তারা কী ধরনের শারীরিক সমস্যায় ভুগছেন? প্রশ্নটা এ কারণে যে, কর্মক্ষেত্রে মাত্রাতিরিক্ত কাজের চাপের পরও সাংবাদিকদের পর্যাপ্ত মেডিকেল পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয় না।

পেশাগত অনিশ্চয়তার কারণে মানসিক চাপের ফলে অকস্মাৎ কোনো সাংবাদিকের মৃত্যু হলে তার পরিবারের দায়িত্ব কে নেবে? হঠাৎ করে ওই পরিবারটি যে অকূলপাথারে পড়ে যায়, সেখান থেকে উত্তরণে রাষ্ট্র তো দূরে থাক, সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোও কি কোনো দায় অনুভব করে?

হাতেগোনা কিছু পত্রিকা ওয়েজ বোর্ড অনুযায়ী বেতন দেয়। কিন্তু ঢাকার বাইরের রিপোর্টাররা সেই ওয়েজ বোর্ডে বেতন পান কি না, সেটি বিরাট প্রশ্ন। মামুন রেজা যে পত্রিকায় কাজ করতেন, সেটিও ওয়েজ বোর্ড অনুযায়ী বেতন দেয় বলে জানি। সেই হিসাবে কিছু টাকা হয়তো তিনি প্রতিষ্ঠান থেকে পাবেন। কিন্তু টেলিভিশন চ্যানেলগুলোয় কোনো ওয়েজ বোর্ড নেই। বহু বছর ধরেই এই দাবি আছে। আলোর মুখ দেখেনি। ফলে একজন সাংবাদিক বছরের পর বছর ধরে একটা টেলিভিশন চ্যানেল চাকরি করার পরে যখন সেই প্রতিষ্ঠান ছেড়ে দেন বা তাকে যদি বাদ দেওয়া হয়, তাহলে কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিলে তাকে শূন্য হাতেই যেতে হয়।

এই শূন্য হাতে চলে যাওয়া পেশার নাম সাংবাদিকতা। যারা অন্যের অধিকার নিয়ে সোচ্চার। পোশাক শ্রমিকরা বকেয়া বেতনের দাবিতে রাস্তায় নামলে সাংবাদিকরা সেখানে ছুটে যান। টেলিভিশনে লাইভ দেন। অথচ তার নিজের বেতনেরই হয়তো খবর নেই। তার নিজের সন্তানের দুধ কেনার টাকা আছে কি না, সেই খবর কে রাখে!

মোদ্দা কথা, সাংবাদিকতা মানে যদি প্রকৃত অর্থে সাংবাদিকতাই হয়, তাহলে পেশাগত নিশ্চয়তা ছাড়া কারো পক্ষে সাংবাদিকতা করা সম্ভব নয়। কেননা, সংবাদকর্মীকে যদি সারাক্ষণ নিজের চাকরি বাঁচানো কিংবা মাস শেষে বেতন হবে কি না; মূল্যস্ফীতির সঙ্গে সঙ্গতি রেখে বছর শেষে ইনক্রিমেন্ট হবে কি না; নির্দিষ্ট সময়ের পরে পদোন্নতি হবে কি না—এসব নিয়ে চিন্তা করতে হয়; বয়স ও বেতন বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে যদি তার চাকরির বাজার সংকুচিত হতে থাকে এবং জীবনের একটা পর্যায়ে গিয়ে যদি তার মধ্যে এই উপলব্ধি তৈরি হয় যে, সাংবাদিকতায় এসে ভুল করেছি—তাহলে তার পক্ষে বস্তুনিষ্ঠ, নিরপেক্ষ ও নির্মোহ সাংবাদিকতা করা সম্ভব নয়।

সিনিয়র সাংবাদিক কামাল আহমেদের নেতৃত্বে গঠিত গণমাধ্যম সংস্কার কমিশন সম্প্রতি যে প্রতিবেদন দিয়েছে, সেখানেও সাংবাদিকদের এই পেশাগত অনিশ্চয়তার বিষয়টি উঠে এসেছে। কমিশন মনে করে, সাংবাদিক ও গণমাধ্যমকর্মীদের আর্থিক নিরাপত্তা মূলত তাদের গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানের আর্থিক অবস্থার ওপর নির্ভরশীল। তাই এ প্রতিষ্ঠানগুলোর অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতাও সমান গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের গত পাঁচ দশকের গণমাধ্যম বিকাশে সাংবাদিকদের আর্থিক নিরাপত্তার দিকে তেমন নজর দেওয়া হয়নি। বর্তমানে অধিকাংশ গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান ব্যবসায়ী গোষ্ঠী, রাজনৈতিক প্রভাবশালী ব্যক্তি বা করপোরেট প্রতিষ্ঠানের মালিকানাধীন। তবে তাদের মধ্যে খুব কমই সাংবাদিকদের ন্যায্য বেতন-ভাতা এবং সুযোগ-সুবিধার প্রতি প্রয়োজনীয় মনোযোগ দিয়েছে।

বাংলাদেশের শ্রম আইন অনুযায়ী সব পেশার শ্রমিকদের আর্থিক নিরাপত্তা ও পেশাগত সুরক্ষা নিশ্চিত করার কথা থাকলেও গত ৫৪ বছরে গণমাধ্যমকর্মীদের ক্ষেত্রে তা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। এর মূল কারণ, অন্যান্য পেশায় শ্রম আইন যতটা প্রয়োগ হয়েছে, সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে তা একেবারেই অপ্রতুল। সংবাদপত্রের ক্ষেত্রেও নিউজপেপার এমপ্লয়িজ (কন্ডিশন্স অব সার্ভিস) অ্যাক্ট ১৯৭৩-এর বিধানসমূহ যথাযথভাবে প্রতিপালিত হয়নি। এছাড়া প্রেস কাউন্সিলকেও সাংবাদিকদের জীবন-জীবিকার সুরক্ষার বিষয়ে কোনো ভূমিকা বা এখতিয়ার দেওয়া হয়নি।

দীপু হাসান, লিটন বাশার, মামুন রেজা, সুদীপ দে মারা যাবেন। সংবাদ হবে। সহকর্মী ও সুহৃদরা ফেইসবুকে আবেগঘন পোস্ট দেবেন। কমেন্ট করবেন। ফেইসবুকে নতুন ইস্যু চলে আসবে। ওই মৃত্যুর সংবাদটি দ্রুতই হারিয়ে যাবে। তুরস্কের কবি নাজিম হিকমতের ‘জেলখানার চিঠি’ কবিতার একটি লাইন: ‘বিংশ শতাব্দীতে মানুষের শোকের আয়ু বড়জোর এক বছর।’ এখন এই একবিংশ শতাব্দীতে সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে লাইনটি হয়তো এমন হবে: সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে মানুষের শোকের আয়ু বড়জোর একটি স্ট্যাটাস!


  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ৩৫২ জন, মৃত্যু ১

অনির্দিষ্টকালের জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ বন্ধ ঘোষণা, হল ছাড়ার নির্দেশ

রাজশাহীতে আমের দাম পাচ্ছে না কৃষক

যুদ্ধের কারণে বাণিজ্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে: বাণিজ্য উপদেষ্টা

সরকারের সহযোগিতা ছাড়া নির্বাচন সম্ভব নয়: সিইসি

ইরান এখন খাকি পোশাকের হাতে — আধ্যাত্মিকতা পেছনে, বন্দুক সামনে

নতুন বাজারে ইউআইইউ শিক্ষার্থীদের সড়ক অবরোধ, বন্ধ যান চলাচল

মামুন রেজা মরে গেলেন, কী বলে গেলেন?

ত্রিপক্ষীয় নতুন জোটে বাংলাদেশ-চীন-পাকিস্তান, পররাষ্ট্রসচিব পর্যায়ের বৈঠক

তারেক রহমান দেশে ফেরার প্রস্তুতি নিচ্ছেন: খসরু

১০

সারাদেশে পুলিশের বিশেষ অভিযান, গ্রেফতার ১৭৮২

১১

জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের সুপারিশ দ্রুত বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত

১২