জবি শিক্ষার্থী সিফাতের ভাবনায় চট্রগ্রাম-আরাকান করিডর 

একটা সময় ছিল, যখন আরাকান মানে ছিল গানের কথা, কবিতার উপমা। এখন আরাকান মানে রোহিঙ্গা, বন্দুক, বারুদের গন্ধ। আবার সেই আরাকানকে কেন্দ্র করেই আলোচনায় এসেছে ‘চট্টগ্রাম-আরাকান করিডর’।

কেউ বলছে, এটি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সিল্ক রোড হবে। কেউ বলছে, বঙ্গোপসাগরে চীনের ঢুকবার পথ। কিন্তু প্রশ্ন থাকে—এই করিডর কার জন্য, কীসের জন্য, আর কী হারিয়ে যাবে এই সংযোগের বিনিময়ে?

চট্টগ্রাম বাংলাদেশের দ্বাররক্ষক। সমুদ্র, পাহাড় আর মানুষের মিলনস্থল। আবার রাখাইন—মিয়ানমারের এক বিবর্ণ, রক্তাক্ত রাজ্য, যেখানে মানুষ জন্মায় উদ্বাস্তু হয়ে, দেশহীন হয়ে। এই দুই অঞ্চলের মাঝ দিয়ে যে করিডর তৈরি হতে যাচ্ছে—অন্তত ভাবা হচ্ছে—তার অর্থ কেবল পণ্যবাহী ট্রাক নয়, বরং বহুমাত্রিক বাস্তবতা।

আমাদের দেখতে হবে, এই করিডর শুধুই অর্থনীতির নামান্তর নয়। এর পেছনে রয়েছে রাজনীতি, সামরিক কৌশল, এবং ভূ-রাজনৈতিক চাপ। করিডর মানেই শুধু রাস্তাঘাট না—করিডর মানে প্রভাব, নিয়ন্ত্রণ, দখল। আর এই দখল অনেক সময় চোখে পড়ে না, বোঝা যায় না—শুধু ফুরিয়ে যায় আকাশটা, শুকিয়ে যায় নদীটা, হারিয়ে যায় আত্মপরিচয়ের মাটিটা।

এই যে করিডর নির্মাণের কথা, তার মাধ্যমে চীন বঙ্গোপসাগরে সরাসরি প্রবেশাধিকার পাবে। তাদের কিয়াউকফিউ বন্দর হয়ে ট্রান্সপোর্ট যাবে চট্টগ্রাম বন্দরে। শুনতে ভালোই লাগে, কিন্তু ভেবে দেখেছেন কি—এই প্রবেশাধিকার কাদের জন্য সুফল বয়ে আনবে? বাংলাদেশ কি শুধু একটি পার হয়ে যাওয়ার রুট হয়ে যাবে? চট্টগ্রামের সন্তানরা কি এই করিডরের অংশীদার, নাকি শুধু দর্শক?

আর করিডরের নিরাপত্তা? রাখাইন অঞ্চল আজও স্থির নয়। সেখানকার মানুষের মনেও আগুন। রোহিঙ্গারা আমাদের দেশেই শরণার্থী। তাদের তিক্ত অভিজ্ঞতা আমাদের সীমান্তে বিস্ফোরণ ঘটাতে পারে যেকোনো সময়। এই করিডর সেই বারুদের স্তুপের ওপর দিয়ে গঠিত।

আরও গভীর ভয় আছে—পরিবেশের। করিডরের জন্য পার্বত্য চট্টগ্রামের ভেতর দিয়ে নির্মাণ করতে হবে নতুন রাস্তা, রেললাইন। এই অঞ্চল তো শুধু মাটি না, এটি জীববৈচিত্র্যের আশ্রয়, পাহাড়িদের সংস্কৃতির স্থান, এবং প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষাকারী এক জ্যান্ত কাঠামো। এই করিডর সেই কাঠামোতে ফাটল ধরাতে পারে।

তারপর আসে ভূরাজনীতি। চীন যদি এই করিডরের প্রধান স্টেকহোল্ডার হয়, তাহলে ভারত নিশ্চয় হাত গুটিয়ে বসে থাকবে না। এই দুই পরাশক্তির প্রতিদ্বন্দ্বিতার মাঝখানে পড়ে বাংলাদেশ যেন নিজের পায়ে কুড়াল না মারে। করিডর করতে গিয়ে যদি আমরা আমাদের কূটনৈতিক ভারসাম্য হারাই, তবে অর্জনের চেয়ে ক্ষতির পাল্লা ভারি হয়ে যাবে।

সবশেষে প্রশ্ন থাকে—এই করিডর দিয়ে কী যাবে, আর কী আসবে? পণ্য যাবে ঠিকই, কিন্তু যদি তা যায় দেশের ভূমি, পরিচিতি, নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতার বিনিময়ে—তাহলে কি লাভ হবে এই উন্নয়নের?

উন্নয়ন যেন হয় মানুষের জন্য, প্রকৃতির সঙ্গে মিল রেখে, জাতির নিজস্ব অবস্থান রক্ষা করে। করিডর হোক—তবে করিডরের আগে হোক প্রশ্ন। প্রশ্ন হোক স্বার্থ নিয়ে, ভবিষ্যৎ নিয়ে, জনগণের অংশগ্রহণ নিয়ে। আর যদি সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে না পাই, তবে করিডর হবে ঠিকই—কিন্তু হয়তো সেই পথেই হারিয়ে যাবে আমাদের বহু কিছুর চাবিকাঠি।


  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

সংখ্যালঘু নির্যাতনের কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি: পুলিশ

ইউক্রেনকে প্যাট্রিয়ট আকাশ প্রতিরক্ষা ক্ষেপণাস্ত্র দেবে যুক্তরাষ্ট্র

অভিনেতা বুলবুল আহমেদের ১৫তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ

মুক্তি পেতে যাচ্ছে প্রভাসের রোমান্টিক ভৌতিক সিনেমা ’দ্য রাজা সাব’

‘জাতীয় সংস্কারক’ উপাধি পেতে ইচ্ছুক নন ড. ইউনূস'

ফরিদা পারভীনের বর্তমান শারীরিক অবস্থা জানালেন চিকিৎসক

কাজিরহাট লঞ্চঘাটে ৪৮ ভরি স্বর্ণের আংটি সহ নারী আটক

‘জুলাই গণ–অভ্যুত্থান স্মৃতি জাদুঘরে’র কাজে ব্যয় হবে ১১১ কোটি টাকার বেশি

তারেক-বাবরের খালাসের বিরুদ্ধে আপিল শুনানি ১৭ জুলাই

বিশ্ববাজারে কমতে শুরু করেছে তেলের দাম

১০

বিরামহীন বর্ষায় শ্রমজীবি অসহায় মানুষের জন্য ইউএনও'র উদ্যোগ

১১

বেইজিংয়ে শি জিনপিং ও ইরানি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বৈঠক

১২