শাহজালালে আরো অগ্নিকাণ্ডের শঙ্কা; তদন্ত প্রতিবেদন জমা

শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় প্রতিবেদন দাখিল করেছে তদন্ত কমিটি। এতে বলা হয়েছে, বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক), বিমানবন্দরের কুরিয়ার শেডের ইজারাদার এবং বাংলাদেশ বিমানের ব্যর্থতার কারণেই হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে। এসব প্রতিষ্ঠান ইমারত বিধিমালা অনুযায়ী বিমানবন্দরের অগ্নিনিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারেনি। ফলে আগুনে বড় ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। ব্যবস্থা না নিলে শাহজালালে আরো অগ্নিকাণ্ডের শঙ্কা করেছে তদন্ত কমিটি।

গত ১৮ অক্টোবর শাহজালাল বিমানবন্দরে সংঘটিত অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। গতকাল মঙ্গলবার কমিটির সদস্যরা প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে প্রতিবেদন জমা দেন। পরে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের প্রেস উইংয়ের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে এর সারসংক্ষেপ দেওয়া হয়। 

অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় দেশি-বিদেশি বিশেষজ্ঞ ও প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের নিয়ে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছিল। প্রতিবেদনে বিমানবন্দরের এক গুচ্ছ ত্রুটিও সামনে এসেছে। এসব ত্রুটি সংশোধনে কিছু করা হয়েছে। এর মধ্যে বিমানবন্দর পরিচালনার জন্য আলাদা কর্তৃপক্ষ গঠন অন্যতম। তদন্ত কমিটির শঙ্কা, দুর্বল ব্যবস্থাপনার কারণে বিমানবন্দরে এ ধরনের আরও অগ্নিকাণ্ড ঘটতে পারে। 

তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বেবিচক কুরিয়ার শেড এবং কার্গো শেডের ইজারাদাতা হিসেবে ইমারত নির্মাণ বিধিমালা অনুসারে স্থাপনা ও পরিচালনায় যথাযথ সুরক্ষা ও অগ্নিনিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়েছে। এমনকি শেডের যে অংশে অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত, তা কোনো অনুমোদিত নকশা অনুসরণ না করেই তৈরি করা হয়েছে। 

 

ইজারাগ্রহীতা হিসেবে বিমান বাংলাদেশ প্রয়োজনীয় সুরক্ষা পরিষেবা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়েছে। কুরিয়ার এজেন্সিগুলো তাদের কুরিয়ার শেডের যথাযথ অগ্নিনিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারেনি। কুরিয়ার শেডে থাকা পণ্যের প্রায় ৭৫ শতাংশ নিলামযোগ্য ছিল। এসব পণ্য অন্য জায়গায় সরানোর সুযোগ থাকলেও কাস্টমস হাউস তা সরায়নি, নিলামও করেনি। কুরিয়ার শেডের ভেতরে অফিস এলাকায় ফায়ার অ্যালার্ম, স্মোক ডিটেক্টর ও স্প্রিংকলার ছিল না। কোনো ফায়ার হাইড্রেন্টও পাওয়া যায়নি। এ কারণে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি যেতে দেরি হয়। উত্তরা ফায়ার ব্রিগেডের অগ্নিনির্বাপক গাড়ি দুপুর ২টা ৫০ মিনিটে পৌঁছে। আবার অ্যাপ্রোন এলাকায় স্তূপ করা পণ্যের কারণে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি অগ্নিকাণ্ডস্থলে যেতে বাধাপ্রাপ্ত হয়। সেখানে প্রায় সব সময় ৪০০ টন পণ্য পড়ে থাকে। আমদানি পণ্য সংরক্ষণের কার্যকর ব্যবস্থাপনা এবং তদারকি ছিল না। দাহ্য ও বিপজ্জনক পণ্যের জন্য সুরক্ষা ব্যবস্থাও ছিল না। বেবিচকের অবকাঠামোর সুরক্ষায় কোনো স্থায়ী ফায়ার স্টেশনও সেখানে স্থাপন করা হয়নি।

কোনো ধরনের নিয়মের তোয়াক্কা ও সতর্কতা ছাড়াই পলিথিনে মোড়ানো কাপড়ের রোল, রাসায়নিক পদার্থ, সংকুচিত বোতলের পারফিউম এবং বডি স্প্রে, ইলেকট্রনিক জিনিসপত্র, ব্যাটারি, ওষুধজাত পণ্যের কাঁচামালের মতো অত্যন্ত দাহ্য ও বিপজ্জনক পদার্থ এলোপাতাড়ি সেখানে স্তূপ করে রাখা ছিল।  

 

কমিটি তদন্তে নেমে বিস্ফোরক, অগ্নিসংযোগ, বৈদ্যুতিক ত্রুটি, রাসায়নিক বা গানপাউডারের বিষয়গুলোর অস্তিত্ব পর্যালোচনা করে। এ সময় ৯৯ সাক্ষীর মৌখিক ও লিখিত সাক্ষ্য নেওয়া হয়। এর মধ্যে সিভিল এভিয়েশন, বিমান বাংলাদেশ, কাস্টমসসহ বিভিন্ন শাখার লোকজন রয়েছে। এ ছাড়া ডিজিএফআই বিমান, এনএসআই, এপিবিএন, কাস্টমস, কুরিয়ার এজেন্সি এবং বিভিন্ন মিডিয়ার কাছ থেকে সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করে সেগুলো পর্যালোচনা করে। এসব থেকে কমিটি নিশ্চিত হয়– কুরিয়ার শেডের বর্ধিত অংশের উত্তর-পশ্চিম কোণে থাকা ডিএইচএল, আরএস এবং এসআরকে কুরিয়ার এজেন্সির খাঁচাগুলোর মধ্যবর্তী স্থানে অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত। তুরস্ক থেকে আসা বিশেষজ্ঞ দল, বুয়েট বিশেষজ্ঞ, অগ্নিনির্বাপক বিশেষজ্ঞ এবং সিআইডি ফরেনসিকের প্রতিবেদন থেকেও এগুলো স্পষ্ট হয়। 

তদন্ত কমিটি প্রধান ত্রুটি হিসেবে বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড অনুসরণ না করাকেই চিহ্নিত করেছে। এ ছাড়া ২০১৩ সাল থেকে ৭টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে, যা প্রতিরোধ ও নির্বাপণে বেবিচকের কোনো প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা ছিল না। গত ২৭ অক্টোবর সরেজমিন পরিদর্শন করে প্রতীয়মান– বেবিচকের ফায়ার সার্ভিসের অবকাঠামো সরঞ্জাম ও প্রশিক্ষণের অপ্রতুলতা রয়েছে।

৯ বছর ধরে বেবিচক এবং এফএসসিডির (ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স) মধ্যে একটি সমঝোতা স্মারকের জন্য পত্রালাপ করা হচ্ছে; এ পর্যন্ত সমঝোতা স্মারক সই হয়নি। বিপজ্জনক পণ্যের গুদাম ভিন্ন স্থানে স্থানান্তরে ২০২১ সালের বিএনএসিডব্লিউসির (বাংলাদেশ জাতীয় কর্তৃপক্ষ, রাসায়নিক অস্ত্র কনভেনশন) সুপারিশ উপেক্ষা করা হয়েছে।

বিদ্যমান ব্যবস্থা থেকে সরে এসে বিমানবন্দর কার্যক্রমের রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচালনায় একটি স্বতন্ত্র কর্তৃপক্ষ প্রতিষ্ঠার সুপারিশ করা হয়েছে। বেবিচক শুধু নিয়ন্ত্রণকারী বা রেগুলেটর হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে পারে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, এই কেপিআইভুক্ত এলাকার সুরক্ষা নিশ্চিত করতে সিভিল এভিয়েশন অথরটি, আন্তর্জাতিক বিমান চলাচল আইন আইকাও এবং ন্যাশনাল বিল্ডিং কোডের বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে।  

এ ছাড়া বিমান বাংলাদেশের কার্যক্রম শুধু ফ্লাইট পরিচালনার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার কথা বলা হয়েছে। সিভিল এভিয়েশনের মাধ্যমে নিযুক্ত দক্ষ অপারেটরকে গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং এবং অন্যান্য কার্যক্রমের দায়িত্ব দিতে হবে। ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের সঙ্গে সমন্বয় করে দ্রুত সময়ের মধ্যে একটি বিশেষ শ্রেণির ফায়ার স্টেশন নির্মাণের ব্যবস্থা করতে হবে। বিমানবন্দরে জরুরি ভিত্তিতে ফায়ার সেফটি প্ল্যান প্রণয়ন করা প্রয়োজন। স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক নিয়ম অনুসরণ করে বিপজ্জনক পণ্য এবং রাসায়নিক গুদাম অন্যত্র স্থানান্তর, নিলামযোগ্য পণ্যের জন্য আলাদা কাস্টমস গুদাম স্থাপন, অ্যাপ্রোন এলাকায় মালপত্র মজুত নিষিদ্ধের সুপারিশ করা হয়েছে। 

তদন্ত কমিটিতে তুরস্কের বিশেষজ্ঞ টিমের সদস্য ছাড়াও দেশের ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স, অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) ফরেনসিক, আর্মড ফোর্সেস ডিভিশন (এএফডি), জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা (এনএসআই), বিস্ফোরক পরিদপ্তর, ঢাকা বিদ্যুৎ সরবরাহ কোম্পানি লিমিটেড (ডেসকো), কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি), বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট), বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের বিশেষজ্ঞ এবং কারিগরি ব্যক্তিরা ছিলেন। এ ছাড়া তুরস্কের আফাদ নামে একটি প্রতিষ্ঠানের বিশেষজ্ঞ দল এ তদন্ত কাজে সহযোগিতা করেছে। 


  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

হোয়াটসঅ্যাপে এলো নতুন নোট ফিচার, জেনে নিন ব্যবহারের উপায়

চবিতে ভর্তি পরীক্ষার ফি কমানোর দাবিতে শিক্ষার্থীদের অবস্থান কর্মসূচি

লেবাননে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে গেলেন নৌবাহিনীর ৮৫ সদস্য

ডেঙ্গুতে আরও ৩ জনের মৃত্যু, একদিনে হাসপাতালে ৬১৫

চুয়াডাঙ্গায় জাতীয় প্রাণিসম্পদ সপ্তাহ ও প্রদর্শনী শুরু

৮২৬ বিচারককে বদলি ও পদোন্নতি দিয়ে প্রজ্ঞাপন

সারের দাম বাড়ার কোনো সম্ভাবনা নেই: কৃষি উপদেষ্টা

শেখ হাসিনার মৃত্যুদণ্ডের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ

নতুন সিনেমায় মিস ওয়ার্ল্ড বাংলাদেশ তোরসা

হংকংয়ে আবাসিক ভবনে ভয়াবহ আগুন, নিহত ৪

১০

শ্রীলঙ্কাকে উড়িয়ে বাংলাদেশের জয়

১১

ফজলুর রহমানের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার অভিযোগ

১২