সাধারণত বাজারে যে তেলাপিয়া মাছ পাওয়া যায়, সেগুলোর আকার খুব বড় হয় না। এক কেজি ওজনের তেলাপিয়াও তেমন চোখে পড়ে না। তবে নতুন এক তেলাপিয়ার প্রজাতি উদ্ভাবন করে তাক লাগিয়ে দিয়েছে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিএফআরআই)। এ প্রজাতির তেলাপিয়া মাছ সর্বোচ্চ আড়াই কেজি ওজনও হয়ে থাকে। দেখতে যেমন বাহারি, তেমনি খেতেও অনেক সুস্বাদু।
বিএফআরআই দেশে মোট মাছের উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে যে গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছে, তারই ফল হিসেবে উদ্ভাবিত হয়েছে এই নতুন প্রজাতি। ইনস্টিটিউটের সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশে জনসংখ্যা বাড়ছে। কিন্তু জমির পরিমাণ বাড়ছে না।
এছাড়া জলবায়ু পরিবর্তন, অতি আহরণ, জলাশয় সংকোচনের কারণে মাছ উৎপাদনে ভাটা পড়ছে। এ সমস্যা মোকাবিলার জন্য মাছের নতুন নতুন জাত উদ্ভাবন করছে বিএফআরআই। যেন স্বল্প সময়ে ও স্বল্প জায়গা ব্যবহার করে অধিক মাছ উৎপাদন করা যায়।
বিএফআরআইয়ের তথ্য মতে, দেশে বছরে মাছের উৎপাদন ৪৫ লাখ মেট্রিক টন। এর মধ্যে তেলাপিয়া চাষ হয় তিন লাখ ৯০ হাজার মেট্রিক টন। মোট মাছের উৎপাদন দ্বিগুণ করে ২০৪১ সালে ৯০ লাখ মেট্রিক টনে উন্নীত করতে চায় বিএফআরআই। এ লক্ষ্যে বাজারে প্রচলিত ও চাহিদাসম্পন্ন কয়েকটি মাছের নতুন জাত উদ্ভাবন করেছে প্রতিষ্ঠানটি। এরই অংশ হিসেবে তেলাপিয়ার এই ১৩তম প্রজাতি উদ্ভাবন করা হয়েছে।
গবেষণার বিষয়ে ইনস্টিটিউটের গবেষকরা বলছেন, ময়মনসিংহে বিএফআরআইয়ের পুকুরে মাছের নতুন প্রজাতি উদ্ভাবনের কার্যক্রম চলছে। তেলাপিয়ার জার্মপ্লাজমা সংরক্ষণ এবং জেনেটিক সিলেকশন পদ্ধতিতে আরও উন্নত প্রজাতি উদ্ভাবনের লক্ষ্যে গবেষণা পরিচালনা করা হয়। ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা জেনেটিক গবেষণায় ফ্যামিলি সিলেকশন প্রটোকল অনুসরণ করে উচ্চ ফলনশীল গিফট তেলাপিয়ার ১৩তম প্রজাতি উদ্ভাবন করেন, যা প্রচলিত তেলাপিয়ার চেয়ে দ্রুত বর্ধনশীল ও ৬২ শতাংশ বেশি উৎপাদনশীল। পুকুরে মাত্র ছয় মাসেই ৬০০ গ্রাম ওজন হয় এই জাতের। এই প্রজাতি প্রচলিত রঙের পাশাপাশি লাল-সাদাও হয়। খেতেও বেশ সুস্বাদু।
নতুন প্রজাতির তেলাপিয়ার রোগ প্রতিরোগ ক্ষমতা বেশি। বাঁচার হার মূল জাতের তেলাপিয়ার তুলনায় বেশি। উপকূলীয় জলাশয়েও চাষোপযোগী। প্রধান খাবার খইল, ভুসি ও গমের কুড়া। বর্তমানে মূল জাতের তেলাপিয়ার হেক্টরপ্রতি উৎপাদন ৯ হাজার কেজি। অন্যদিকে নতুন জাতের তেলাপিয়ার উৎপাদন হবে হেক্টরপ্রতি ১৩ হাজার কেজি। অধিক ফলনশীল এ প্রজাতি চাষের মাধ্যমে তেলাপিয়া দুই লাখ ৪২ হাজার মেট্রিক টন বেশি উৎপাদন করা যাবে বলে আশাবাদী সংশ্লিষ্টরা।
কর্মকর্তাদের ভাষ্যে, বর্তমানে বিশ্বের ১০টি তেলাপিয়া উৎপাদনকারী দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান চতুর্থ। তেলাপিয়ার জাত আমদানি, উন্নত গবেষণা, উন্নত জাত উদ্ভাবন এবং বাংলাদেশে ৪০০টির বেশি তেলাপিয়া হ্যাচারি ও ১৫ হাজার ছোট-বড় আকারের বাণিজ্যিক খামার স্থাপনের ফলেই এ অর্জন। উন্নত চাষ ব্যবস্থাপনা সার্বিকভাবে তেলাপিয়া উৎপাদনকে আরও বেগবান করেছে। অবশ্য এই উৎপাদন বৃদ্ধির পেছনে দেশের দক্ষিণাঞ্চল বিশেষ করে খুলনা, বরিশাল এবং চট্টগ্রাম অঞ্চলের উপকূলীয় চিংড়ি চাষে রোগবালাইয়ের সংক্রমণও ভূমিকা রাখছে। কারণ রোগবালাইয়ের কারণে চাষিরা চিংড়ি চাষে নিরুৎসাহিত হয়ে পড়েছেন। তারা খামারগুলোতে বিকল্প হিসেবে তেলাপিয়া চাষে আগ্রহী হচ্ছেন।
দেশের ময়মনসিংহ, যশোর, নড়াইল, লক্ষ্মীপুর, বাগেরহাট ও বরগুনায় মোট সাতটি তেলাপিয়া ব্রিডিং নিউক্লিয়াস স্থাপন করা হয়েছে। ব্রিডিং এবং রোটেশনাল ব্রিডিং পদ্ধতির মাধ্যমে বিশেষ প্রক্রিয়ায় উন্নত জাতের তেলাপিয়ার উৎপাদন ও বিতরণের কাজ চলমান। তেলাপিয়ার বাণিজ্যিক হ্যাচারি স্থাপন এবং সব পুরুষ মনোসেক্স তেলাপিয়া পোনা উৎপাদন করা হয়েছে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল বিশেষ করে ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কক্সবাজার, কুমিল্লা, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, ময়মনসিংহ, কিশোরগঞ্জ, বগুড়া, রাজশাহীতে তেলাপিয়া হ্যাচারি স্থাপনের উদ্যোগ ব্যাপক হারে লক্ষ্য করা গেছে। ইতোমধ্যে এসব এলাকায় মোট ৪০০টিরও বেশি হ্যাচারি স্থাপিত হয়েছে। এসব তেলাপিয়া হ্যাচারির ডিজাইনসহ সার্বিক ব্যবস্থাপনায় রয়েছে বিএফআরআই।
এদিকে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে রুই মাছেরও নতুন একটি প্রজাতি উদ্ভাবন করেছেন মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা। জেনেটিক গবেষণার মাধ্যমে যমুনা, ব্রহ্মপুত্র ও হালদা নদীর প্রাকৃতিক উৎসের রুই মাছ ব্যবহার করা হয়েছে নতুন প্রজাতি উদ্ভাবনে। চতুর্থ এ প্রজাতির নাম দেওয়া হয়েছে ‘সুবর্ণ রুই’। এটিও দ্রুত বর্ধনশীল, মূল জাতের চেয়ে ২০ দশমিক ১২ শতাংশ অধিক উৎপাদনশীল। খেতে সুস্বাদু; দেখতে লালচে; অন্তঃপ্রজনন সমস্যামুক্ত।
সার্বিক বিষয়ে বিএফআরআই মহাপরিচালক ড. ইয়াহিয়া মাহমুদ বলেন, চাষের মাছের উৎপাদন যদি বৃদ্ধি করতে চাই; তবে জাত উন্নয়ন একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সেই লক্ষ্যে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট মাছের জাত উদ্ভাবনে কাজ করছে। ২০৪১ সালে আমরা মাছের উৎপাদন ৯০ লাখে উন্নীত করবো। এই উৎপাদনে পৌঁছাতে হলে বিজ্ঞানভিত্তিক চাষাবাদের পাশাপাশি জাত উদ্ভাবন বিষয়টিকে আমাদের বিবেচনায় রাখতে হবে।
তিনি বলেন, আমরা সম্প্রতি রুই মাছের একটা জাত উদ্ভাবন করেছি। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর প্রাক্কালে এটি উদ্ভাবন করা হয়েছে বিধায় এর নাম দিয়েছি ‘সুবর্ণ রুই’। নতুন প্রজাতিটি চাষিদের কাছে বিতরণ করেছি। তারাও এর উৎপাদন কার্যক্রম শুরু করেছেন। এই প্রজাতির মাধ্যমে অতিরিক্ত এক লাখ মেট্রিক টন অতিরিক্ত রুই মাছ উৎপাদন করা সম্ভব হবে।
তেলাপিয়ার নতুন প্রজাতি উদ্ভাবন প্রসঙ্গে ড. ইয়াহিয়া বলেন, আমরা তেলাপিয়া, সাদা পাঙ্গাশ, সরপুঁটি নিয়েও গবেষণা করছি। তেলাপিয়ার ১৩তম প্রজাতি উদ্ভাবিত হয়েছে। মূল প্রজাতির চেয়ে যা ৬২ শতাংশ অধিক উৎপাদনশীল। তেলাপিয়া নিয়ে আমরা বিশ্বে গর্ব করতে পারি। তেলাপিয়া উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে চতুর্থ। তেলাপিয়া উৎপাদন প্রায় চার লাখ মেট্রিক টন। এটা সাধারণ ভোক্তাদের মাছ। সাধারণ ভোক্তা এই মাছ খেতে পছন্দ করেন। স্বল্পমূল্যে এই মাছ বাজারে পাওয়া যায়। আমাদের কাছে এখন যে তেলাপিয়া আছে (নতুন প্রজাতি) প্রতিটার ওজন দুই থেকে আড়াই কেজি।